কক্সবাজারের পেকুয়ায় টইটংয়ের সোনাইছড়ি ছড়াতে চলছে বালি উত্তোলনের মহোৎসব। বনবিভাগের মালিকানাধীন রিজার্ভ সম্পত্তি থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন যজ্ঞে মেতে উঠেছে প্রভাবশালী বালিখেকো চক্র। তারা পাহাড়ী প্রবাহমান ছড়ায় স্যালো মেশিন বসিয়ে প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছেন বালি উত্তোলনকাজ। এতে করে উপজেলার টইটং ইউনিয়নের সোনাইছড়ি ছড়াসহ এর নিকটবর্তী স্থানে পাহাড়, উঁচু ও মাঝারী উচ্চতার টিলাগুলি চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। টিলা ধসে চলছে বালি উত্তোলন। এতে করে ছড়ার গতি হচ্ছে পরিবর্তন। ছড়ার পার্শ্ববর্তী স্থানে রিজার্ভ জমিতে মানুষের প্রচুর বসতভিটা ও বাড়ি রয়েছে। বালি উত্তোলনের ফলে এ সব ভিটাসমূহ বিলীন হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। সোনাইছড়ি ছড়ার নিকটে প্রায় ২ একর আয়তনের একটি প্রাচীন গোরস্থান রয়েছে। স্থানীয়ভাবে টইটংয়ের সোনাইছড়ি বড় কবরস্থান নামে সেটির পরিচয় রয়েছে। বালি উত্তোলনের ফলে ওই কবরস্থানের প্রায় ৬০ শতক জায়গা গিরিখাতে রুপান্তর হয়েছে। শ্রেণী পরিবর্তন করে ওই চক্র কবরস্থানের জায়গা থেকেও তুলছে বালি। ফলে কবরস্থানের পার্শ্বে প্রবাহমান পাহাড়ী ছড়ার প্রশস্ত বেড়ে গেছে। বড় কবরস্থানের অংশে সোনাইছড়ি ছড়ার গভীরতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, কবরস্থানের উত্তর পাশে প্রায় ৬০ শতক মতো জায়গা ছড়া অংশে বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় শতাধিক কবর পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। সোনাইছড়ি ছড়ায় বালি উত্তোলনের সচিত্র প্রতিবেদন প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে দেখা গেছে উপজেলার টইটং ইউনিয়নের সোনাইছড়ি ঢালার মুখ শফি আলম সওদাগরের দোকানের উত্তর পাশে বালি উত্তোলন কাজ চলমান রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, টইটং ইউপির ৪ নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য নবী হোসাইন প্রকাশ নবু মেম্বার ও তার ছেলে খোকন সোনাইছড়ি ছড়া থেকে বালি উত্তোলন করছে। তারা প্রতিনিয়ত ওই ছড়া থেকে বালি উত্তোলন করে চলছে। চৌকিদারপাড়ার ১০ থেকে ১৫ টি বসতভিটার নিকট থেকে তোলা হচ্ছে এ সব বালি। সোনাইছড়ি ছড়ায় বালি হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান সময়ে চলছে অনাবৃষ্টি। ছড়ায় নেই পানির ¯্রােতধারা। পাহাড় থেকে নেমে আসা ওই ছড়ায় এখন পানির স্তর একদম নি¤েœ। তবে ছড়ায় বালি না থাকলেও চলছে বালি উত্তোলন কাজ। দেখা গেছে, নবু মেম্বার নিজেই একটি স্যালো মেশিন চালু রেখেছে ছড়ায়। তার ছেলে খোকন পৃথক দুটি স্যালো মেশিন বসিয়েছে। সর্বোচ্চ ৩ চেইনের ব্যবধানে পিতা-পুত্রের বালি উত্তোলন প্রতিযোগিতায় স্থানীয়রা যেন দর্শক। ছড়ার বিপরীত প্রান্তে চৌকিদারপাড়ায় বিধবা শাকেরা বেগমের বসতবাড়ি। এর নিকটে মৃত রওশন আলীর ৩ পুত্র আশরাফ মিয়া, নওশা মিয়া ও বাদশাহ মিয়ার বাড়ি। তাছাড়াও স্থানীয়দের আরো ৮/১০ টি বসতবাড়ি রয়েছে। ওই বাড়িগুলি ছড়ার লাগোয়া সরকারী রিজার্ভ ভূমির টিলায় স্থিত। ৩ টি মেশিন বসানো হয়েছে ওই ব্যক্তিদের বসতভিটার নিকট সোনাইছড়ি ছড়ায়। উপর থেকে কোদাল দিয়ে বালি ছড়ায় ফেলানো হচ্ছে। সেগুলি পানিতে মিশিয়ে তুলছে বালি হিসেবে। মেশিন বসানো হয়েছে ছড়ার উত্তরকুলে। বালির স্তুপ দেয়া হচ্ছে ছড়ার দক্ষিণকুলে। শফি আলম ও ফারুক সওদাগরের দোকানের নিকট বালির স্তুপ রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রতি গাড়ী বালি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। ৩ টি মেশিনের সাহায্যে প্রতিদিন সেখান থেকে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ ডাম্পার গাড়ী বালি বিক্রি করা হয়। এ সব বালি বিক্রির টাকা বাপ-পুত্রের পকেটে যায়। স্থানীয়রা বালি উত্তোলন কাজে প্রতিবাদ করে। তবে নবু মেম্বার ও তার ছেলে খোকন খুবই উগ্রপন্থী মনোভাবের লোক। তারা ত্রাস প্রকৃতির লোক হওয়ায় এদের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়না। এ ব্যাপারে চৌকিদারপাড়ার বাসিন্দা মৃত কামাল হোসেনের স্ত্রী শাকেরা বেগম বলেন, ছড়া থেকে নয়। এখন তারা বালি তুলছে আমার ভিটা থেকে। ৪০ শতক মতো জায়গা গর্ত হয়ে গেছে। আমরা রিজার্ভে আছি। আমার শাশুড় শফিকুর রহমান প্রকাশ সবু চৌকিদার আমার বিয়ের সময় স্বর্ণের বদলে জায়গাটি আমাকে দিয়েছে। আমার ৩ পুত্রের মধ্যে নবী আলম মারা গেছে। তার স্ত্রীর ৩ সন্তান রয়েছে। আমিও বিধবা, আমার পুত্রবধূও বিধবা। ৩ সন্তানের পড়ালেখার খরচ ও ভরণপোষণের জন্য ছড়ার নিকটে কলা ও আমবাগান করেছি। এখন মেশিন দিয়ে বাগান ধসে দিয়ে ফেলানো হচ্ছে। সোনাইছড়ি চৌকিদারপাড়ার মাস্টার ছিদ্দিক আহমদের পুত্র আবদু রহিম জানান, আমার ভিটার ৪০ শতক মতো গর্ত করে জোরপূর্বক বালি নিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো জানান, সোনাইছড়িতে একটি বড় কবরস্থান রয়েছে। এটি ১শ বছরের আগের। আগে ছিল ৭ কানি আয়তন। এখন কবরস্থানটি ৫ কানির মতো হবে। ২ কানি ছড়ায় বিলীন হয়েছে। নবু মেম্বার কয়েক বছর ধরে দাপট দেখিয়ে বালি তোলা অব্যাহত রেখেছে। মোস্তাক আহমদ, মোতাহেরা প্রকাশ কাজল, সেতারা বেগম, মনোয়ারা বেগম, আয়েশা বেগম, ৭ম শ্রেনীর ছাত্রী নাসিমা আক্তার, বাদশাহ মিয়া, আশরাফ মিয়াসহ চৌকিদারপাড়ার আরো অনেকে জানান, নবু মেম্বার ও তার ছেলে খোকন পেশীশক্তির জোর দেখিয়ে আমাদের বসতভিটা বিলীন করে বালি লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। গৃহবধূ কাজল জানান, আমার স্বামী বিদেশে জেলে আছে। এখন আমি অসহায়। তারা আমার ভিটা থেকে বালি লুট করছে। মানা করলে দা ও কিরিচ নিয়ে ধেয়ে আসে। ভয় লাগে কিছু বললে। কারণ তারা খুবই হিং¯্র। স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল হক জানান, মানুষের বসতভিটা গর্ত করে বালিগুলি তোলছে। ক্ষতিগ্রস্তরা আমাকেও বিষয়টি জানিয়েছেন। আমি চেয়ারম্যান সাহেবকে বিষয়টি অবহিত করেছি। টইটং ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বিষয়টি আমার জানা আছে। নিষেধ করেছি। কিন্তু তারা আইন কানুন কিছুই মানেনা। মানুষের বসতভিটা ও কবরস্থান হুমকির মধ্যে পড়েছে। পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া যায়নি। বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক জানান, আমি মিটিংয়ে আছি। এ সম্পর্কে পরে জানাবো। চট্টগ্রামের দক্ষিণ বনবিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) আজহারুল ইসলাম জানান, অবৈধ বালি উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি গুরুত্বের সহিত নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদেরকে এখন বলছি।