জাপানী বংশোদ্ভুত সেই দুই শিশুর অভিভাবকত্বের আইনি লড়াই শেষে যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। শিশু দুইটি মায়ের কাছে থাকবে বলে আদেশ দিয়েছেন আদালত।
রবিবার (২৯ জানুয়ারি) ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান এ আদেশ দেন।
অন্যদিকে জাপানি বাবা ইমরান শরীফের পক্ষের আইনজীবী নাছিমা আকতার যুক্তিতর্কে আদালতে বলেন, বাদী বিবাদীর বিয়ে মুসলিম শরীয়তের বিধান অনুসারে হয়েছে। এতে বাচ্চাদের জিম্মার বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে সন্তানরা মায়ের কাছে থাকবে। সাবালক হওয়ার পর বাবার জিম্মায় থাকতে পারে। তবে আইনে মায়ের জিম্মা হারানোর বিষয়ে এটাও বলা আছে, কোন মা যদি বৈবাহিক থাকা অবস্থায় আবাসিক ভবন থেকে দূরে বসবাস করেন তাহলে মা সন্তানদের জিম্মা হারাবেন। কারণ ভরণ পোষণের জন্য বাবাকে দরকার।
বাচ্চাদের মঙ্গলের বিষয় আইনজীবী বাবার পক্ষে আরো বলেন, মা জেরায় স্বীকার করেছেন, প্রতিদিন তিনি ১১ ঘন্টা বাইরে থাকেন। মা যদি সন্ধ্যা ৬ টায় বাসায় আসেন। তাহলে ঘুমানোর আগে ৩ ঘন্টা সময় পান। অন্যদিকে মেয়েদের জন্য বাবা ইমরান শরীফ তুলনামূলক বেশি সময় দেন। একমাত্র জন্মদান বাদে বাবা ছোট বেলা থেকে তাদের দৈনন্দিন যত্নের জন্য বেশি সময় দিয়েছেন। বাদী মা এরিকো জেরায় সেটা স্বীকার করেছেন। জীবনের সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাদের জন্য লড়ে যাচ্ছেন বাবা। বাবার কাছে থাকলে মেয়েরা ভালো থাকবে। মেয়েরাও বাবাকে চায়। বাবা সম্পূর্ণ ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে। বাবার গাইড লাইনে মেয়েরা ভালো থাকবে।
এছাড়া বাচ্চাদের এদেশে মানুষ হওয়ার বিষয়ে আইনজীবী নাসিমা আক্তার বলেন, জাপানে আইনে চরমভাবে বর্ণ বৈষম্য করা হয়। সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের যে কাউকে তাচ্ছিল্য করা হয়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কেউ ভালো চাকরিতে ঢুকতে পারে না। অথচ বাংলাদেশে বিদেশি কেউ আসলে তাদের যথাযথ মর্যাদা করা হয়। বাংলাদেশ এতো খারাপ দেশ না যে, কোন বাচ্চা ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না। আমাদের দেশ কি এতোটাই খারাপ যে, দুইটা শিশুর ভরণপোষণ করতে পারবে না। বাংলাদেশি বলে কি সন্তান থেকে নিঃসন্তান থাকবেন।
এরআগে গত ১৫ জানুয়ারি জাপানি দুই শিশু ও তাদের বাবা মায়ের বক্তব্য শোনেন পারিবারিক আদালত।
উল্লেখ্য, মা জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকোর সঙ্গে বাংলাদেশি প্রকৌশলী ইমরান শরীফের বিয়ে হয় ২০০৮ সালে। দাম্পত্য কলহের জেরে ২০২০ সালের শুরুতে বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো। ১২ বছরের সংসারে তারা তিন কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। তারা হলো জেসমিন মালিকা, লাইলা লিনা ও সানিয়া হেনা। এরপর ইমরান স্কুলপড়ুয়া বড় দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ছোট মেয়ে জাপানে এরিকোর সঙ্গে থেকে যান।
এরপর ওই দুই মেয়েকে জিম্মায় পেতে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গতবছর জুলাই মাসে বাংলাদেশে আসেন এই জাপানি নারী। তিনি হাই কোর্টে রিট আবেদন করলে তাদের সমঝোতায় আসতে বলেন বিচারক। কিন্তু ওই দম্পতি সমঝোতায় না আসায় কয়েক মাস ধরে শুনানির পর হাই কোর্ট দুই সন্তানকে বাবার হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত দেয়। পাশাপাশি মা যাতে সন্তানদের সাথে দেখা করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে বাবাকে খরচ দিতে বলা হয়।
হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন শিশুদের মা নাকানো এরিকো। পরে আপিল বিভাগ এক আদেশে শিশু দুটিকে মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দিলেও বাবা তা না মানায় বিচারকরা উষ্মা প্রকাশ করেন। পরে আদালত শিশু দুটিকে বাবার হেফাজত থেকে এনে তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং পরে মায়ের হেফাজতে দেওয়ার আদেশ দেয়।
এরপর গত বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়ে কার জিম্মায় থাকবে, তার নিষ্পত্তি হবে পারিবারিক আদালতে এবং তার আগ পর্যন্ত দুই শিশু তাদের মায়ের কাছেই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেয় আপিল বিভাগ। এরপর আপিল বিভাগ থেকে মামলাটি পারিবারিক আদালতে আসে।
এদিকে সন্তানসহ পালানোর চেষ্টার অভিযোগে জাপানি মা এরিকো নাকানোর বিরুদ্ধে সন্তানদের বাবা ইমরান শরিফ গত ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মামলা করেন। যা ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাতুল রাকিব পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।