চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী এলাকায় সংরক্ষিত বনে পাহাড় কাটার উৎসব বন্ধ করতে দুই সচিব, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ ১২ জনকে আইনী নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
নোটিশে পাহাড় কাটা ও সংরক্ষিত বা রক্ষিত বনভূমি ধ্বংসের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে।
একই সাথে যেসব পাহাড় ইতোমধ্যে কাটা হয়েছে ও কি পরিমাণ বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে তার ক্ষতি নিরূপণ করে দোষীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় ও ধ্বংসপ্রাপ্ত পাহাড় ও বনভূমিতে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ দ্বারা বনায়নের দাবি জানানো হয়।
এবিষয়ে নোটিশ গ্রহীতাদের গৃহীত পদক্ষেপ ৭ দিনের মধ্যে নোটিশ প্রেরণকারী আইনজীবীর কাছে অবহিত করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এলাকাবাসীর পরিবেশগত অধিকার রক্ষার স্বার্থে নোটিশ প্রাপ্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মঙ্গলবার (৭ মার্চ) ডাকযোগে নোটিশটি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আইনজীবী জাকিয়া সুলতানা।
যাদেরকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে তারা হলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধান বন সংরক্ষক, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক, চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
নোটিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত কক্সবাজার জেলা প্রাকৃতিক সম্পদে প্রাচুর্যময়। বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সম্পদকে আরও সমৃদ্ধ করেছে এ অঞ্চলের পাহাড়-টিলা, ছড়া, খাল বনভূমি এবং বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত। একারণে এ অঞ্চলটি জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। অপরদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে কক্সবাজার জেলা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে কক্সবাজার জেলার বন, পাহাড় ও জলাধার আজ হুমকির মুখে। জেলার বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড় ও পাহাড়ি বনভূমি। ধ্বংস হচ্ছে এ পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য। স¤প্রতি কয়েকটি পত্রিকায় “ চকরিয়ায় পাহাড়ের কান্না থামাবে কে ” শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এ সংবাদ বেলা’র দৃষ্টিগোচর হয় ও বেলা’কে উদ্বিগ্ন করেছে।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী কক্সবাজারের চকরিয়ায় সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনে বিনা বাধায় উৎসব আকারে চলছে পাহাড় কাটা। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র পাহাড় কেটে মাটি ও বালু বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে বিক্রি করছে মর্মে সংবাদে উল্লেখ রয়েছে। প্রকাশিত এ সংবাদ অনুযায়ী চকরিয়া উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বদিকে নয়াপাড়ার রাজারবিল এলাকায় প্রায় ১০০ একর আয়তনের একটি পাহাড় কাটা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৫০ ফুট উঁচু এ পাহাড়ের অর্ধেকের বেশি কাটা হয়ে গেছে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর বরাত দিয়ে প্রকাশিত এ সংবাদে উল্লেখ রয়েছে যে পাহাড় কাটার সাথে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের উচিতারবিল মৌজায় সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনে ১০টি পাহাড় কাটার কাজ চলছে। ২০০ থেকে ৩০০ ফুট উঁচু ও ১০০ থেকে ২০০ একর আয়তনের পাহাড়গুলোর তিনটি ইতোমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে অন্তত ৮০০ একর রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনে পাহাড় কাটা চললেও তা বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
নোটিশে বলা হয়, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) কক্সবাজার জেলার ৭টি উপজেলায় (কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, টেকনাফ, রামু, চকরিয়া, উখিয়া এবং পেকুয়া উপজেলা) বিদ্যমান পাহাড়, টিলা ও পাহাড়ী বন কর্তন বন্ধে ২০১৯ সালে একটি জনস্বার্থমূলক মামলা দায়ের করে। মামলার প্রাথমিক শুনানী শেষে ৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখে আদালত উল্লেখিত উপজেলাসমুহে বিদ্যমান সকল পাহাড়, টিলা ও পাহাড়ি বন কে কোনো ধরনের পরিবর্তন, রূপান্তর ও কর্তন থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। এছাড়াও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলাসমূহে অবস্থিত সকল পাহাড় কর্তন বন্ধে ২০১১ সালে দায়েরকৃত অপর একটি জনস্বার্থমূলক মামলার চূড়ান্ত শুনানী শেষে ১৯ মার্চ, ২০১২ তারিখে আদালত উল্লেখিত জেলাসমুহে অবস্থিত সকল পাহাড় কর্তন বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। সেইসাথে বন উজাড় বন্ধ করতে এবং পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের অবিরাম প্রবাহ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করেন।
দেশে প্রচলিত আইন ও আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী পাহাড় কাটা/মোচন ও পাহাড়ী বনভূমি ধ্বংস করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পাহাড় কর্তন বন্ধে, পাহাড়ী বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আদালতের জনগুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও কঠোর নির্দেশনা থাকার পরও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে ও পাহাড়ি বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এখনো সক্ষম হয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যা দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম অবজ্ঞা ও উদাসিনতার পরিচায়ক। সেইসাথে আদালত অবমাননার শামীলও বটে।